।।শাহনাজ পারভিন।।
রেল লাইনের ঐ বস্তিতে জন্মেছিলো একটি ছেলে,
ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম না,ও সখিনা গেছোস কিনা ভূইলা আমারে,নেলসন মেন্ডেলা তুমি অমর কবিতার অর্ধমিল,"মায়ের এক ধার দুধের দাম", "আহারে জীবন", "একদিন তোরা যাবি রে", "নাম তার ছিল জন হেনরি" এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়েছেন ফকির আলমগীর। বাংলা লোক ও পপ সংগীতের এক কিংবদন্তী শিল্পী। শুধু একজন গায়ক নন, তিনি ছিলেন একাধারে একজন মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিকর্মী এবং প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তার গানের সুরে যেমন মিশেছিল মাটির টান, তেমনি তার কথায় ছিল সমাজের অন্যায় আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান। দীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য জীবনকালে ফকির আলমগীর তার গান ও কর্মের মাধ্যমে বাঙালির হৃদয়ে এক স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
ফকির আলমগীরের জন্ম ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার কালামৃধা গ্রামে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেন এবং তার গান হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার গাওয়া গান "এই না সোনার বাংলাদেশ" তরুণ প্রজন্মের কাছে বিপুল জনপ্রিয় হয় এবং তাকে প্রতিবাদী শিল্পী হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ফকির আলমগীর একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন এবং তার গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার গাওয়া গানগুলি মানুষকে সাহস ও উদ্দীপনা যুগিয়েছিল।
স্বাধীনতার পর ফকির আলমগীর পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি লোক সংগীত ও পপ সংগীতের মিশ্রণে নিজস্ব একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেন। তার কণ্ঠের বলিষ্ঠতা এবং গানের গভীরতা খুব সহজেই শ্রোতাদের মন জয় করে নেয়। তার গানের মধ্যে একদিকে যেমন ছিল দেশপ্রেম ও মানবতাবোধের কথা, তেমনি অন্যদিকে ছিল সমাজের নানা অসঙ্গতির চিত্রায়ন।
ফকির আলমগীর শুধু গান গেয়েই থেমে থাকেননি। তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তার স্পষ্টবাদীতা এবং নির্ভীক কণ্ঠ তাকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছিল।
দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে ফকির আলমগীর বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৯ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তার জীবন ছিল কর্মময় এবং সৃষ্টিশীল। তিনি তার গানের মাধ্যমে যেমন মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন, তেমনি তাদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতাও বৃদ্ধি করেছেন।
২০২১ সালের ২৩ জুলাই এই কিংবদন্তী শিল্পী কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার প্রয়াণে বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে তার কালজয়ী গান এবং আদর্শ সবসময় আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রেরণা যোগাবে। ফকির আলমগীর কেবল একজন শিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক প্রতিবাদী আত্মা, যিনি গানের সুরে গেঁথেছিলেন মানুষের মুক্তির স্বপ্ন।দিয়ে গেছেন মানবতার মুক্তির বার্তা।
প্রধান সম্পাদক: ওমর ফারুক জালাল, নির্বাহী সম্পাদক-জাফর মাতুব্বর (শাওন)
✆ 01712018902, 01343153240, E-mail: newsajsaradin@gmail.com
©নীলপরী টেলিফিল্ম এর স্বত্ত্বাধিকারী শাহনাজ পারভীন লিনা ইসলাম কর্তৃক ১১/১/বি যুগান্তর রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে সর্ব সত্ত্ব সংরক্ষিত ও প্রকাশিত।